বাঙ্গালা ভাষার অভিধান

১. ক̆

—ব্যঞ্জন বর্ণমালার এবং কবর্গের আদ্যবর্ণ (আলিকালি দ্রষ্টব্য)। কণ্ঠ হতে উচ্চার্য্য বলিয়া, কণ্ঠ্যবর্ণ। কণ্ঠ হতে শব্দ বাহির করিবার কালে জিহ্বামূল তালুর নিকট হতে মুহূর্ত্তের জন্য পথরোধ করিলে, ক এই শব্দ স্বতঃই উচ্চারিত হয়। অল্পায়াসে ও অত্যন্ত অল্প হাওয়া বাহির করিলেই উচ্চারিত হয় বলিয়া ইহাকে ‘অল্প-প্রাণ’ এবং ধ্বনির গাম্ভীর্য্য নাই বলিয়া ‘অঘোষ’ বর্ণ বলে। প্রাণ ও ঘোষ দ্রষ্টব্য। উচ্চারণে ইংরেজি k. এবং ফ়ারসি কাফ় (ك) বর্ণের তুল্য; কিন্তু জিহ্বামূল তালুর পশ্চাতে অর্থাৎ অলিজিহ্বার স্থান হতে হাওয়ার পথ রোধ করিলে মহা-প্রাণ ও ঘোষবান্ খ ও গ ব্যতীত আর এক প্রকার উচ্চারণ বাহির হয়, তাহা অনেকটা ক্ক, ইংরেজি q, এবং আরবী ক়াফ় (ق) বর্ণের তুল্য। বাংলা ভাষায় বহু আরবী শব্দ ব্যবহৃত হওয়ায় ভাষাতত্ত্ববিদ্গণকে ক বর্ণের নিম্নে বিন্দুযুক্ত করিয়া ক় এই নূতন বর্ণের সৃষ্টি করিতে হইয়াছে। সম্ভবতঃ অক্ষয়কুমার দত্ত মহাশয় বাংলা ভাষায় এইরূপ বিন্দুযুক্ত বর্ণের প্রথম প্রবর্ত্তক। চট্টল, মৈমনসিং ঢাকা ইত্যাদি অঞ্চলে কথ্য ভাষায় ‘ক’ স্থলে ‘গ’ উচ্চারিত হয়। যথা— বুক = বুগ।

২. ক̆

[সংস্কৃত। কৈ (শব্দ করা) + অ (ড, কর্ত্তৃবাচ্যে সংজ্ঞার্থে)] বিশেষ্য, প্রজাপতি [বৈদিক] ব্রহ্মা; বিষ্ণু; রুদ্র; সূর্য্য; যম; বায়ু; অগ্নি; দীপ্তি; জল; দক্ষ; কন্দর্প; রাজা; আত্মা; মন; দেহ; মস্তক; কেশ; পক্ষী; ময়ূর; ধন; রোগ; সুখ; শব্দ। বাংলা ভাষায় ক অন্যান্য বর্ণসহযোগে ঐ সকল অর্থ প্রকাশ করে। ককুন্দর, কচ্ছ, কপট, ককুভ, কদলী, কপর্দ্দ ইত্যাদি দ্রষ্টব্য। অনুকার শব্দ। ক এবং ক-বর্গীয় সকল বর্ণই প্রধানতঃ শব্দ-দ্যোতক। ইহা ক-বর্গীয় বর্ণ-যোগে কণ্ঠ্য শব্দ (খক্ খক্, গাঁক্ গাঁক্), চ-বর্গীয় বর্ণ-যোগে শব্দের কোমলতা (কচ্ কচ্, কুচ্ কুচ্), ট- বর্গীয় বর্ণযোগে কাঠিন্য (কট্‌কট্, টকাটক্, ঠক্‌ ঠক্), ত-বর্গীয় বর্ণ-যোগে তারল্য (তক্ তক্, থক্ থক্), প-বর্গীয় বর্ণ-যোগে পবন-ক্রিয়ার (কপ্ কপ্, বক্‌বক্) দ্যোতনা করে। অবিলম্ব বা আকস্মিকতা বাচক। প্রয়োগ— টক্ করে কেটে ফেলা। তাক লাগা। কচ্ করে কাটা। কট্ করে কামড়ান। তীব্রতাব্যঞ্জক। প্রয়োগ— পেট কন্‌কন্ করা। মাথা কট কট করা। লাঠি ঠক ঠক করা। চোক কর কর করা। গা কস্ কস্ করা। পর্য্যন্ত বা সীমা-বোধক। প্রয়োগ— এই তক। ছটাক খানেক। [সংখ্যাবাচক। কয় শব্দের দ্রুত উচ্চারণ হেতু কুঞ্চিত আকার। ক’ ইত্যাদি] বিশেষণ, কি সংখ্যক; কয়টা। প্রয়োগ— ক’ সের দুধ। ক’ গজ কাপড়। ক’ হাজার টাকা। ক’ বৎসর। ক’ দিন। ক’ ঘণ্টা। ক’ জন লোক। পরিমাণবাচক কত অর্থে বিরল ব্যবহার। প্রয়োগ— কখন (কতক্ষন)। বাংলা প্রত্যয়। (১) স্বার্থে। প্রয়োগ— ঝলক; মড়ক; বৈঠক; আদিক। হেনক (= হেন); যেনক (= যেন)। “সাত তাল উচ্চ মঞ্চ জেনক আকাশ।” —শ্রীকৃষ্ণবিলাস। (২) অল্পার্থে। প্রয়োগ— টাক, টুক। (৩) ক্ষুদ্রার্থে (diminutive)। প্রয়োগ—  মানবক, বৃক্ষক। (৪) তুচ্ছার্থে ক-পরে কা। প্রয়োগ— ঢ্যাঙ্গা হট্‌কা, ছোট্‌কা (স্ত্রীলিঙ্গ ছোট্‌কী, ছুট্‌কী)। প্রাচীন বাংলা-বিভক্তি। (১) দ্বিতীয়া বিভক্তি আধুনিক বাংলার ‘কে’ স্থলে ৪০০ বৎসর পূর্ব্বে চলিত ছিল (রূপ নারায়ণের দুর্গা-মঙ্গল দ্রষ্টব্য); এইরূপ— ‘রাধাকে’ স্থলে ‘রাধাক’। প্রাদেশিক ভেদে ‘কু’। প্রয়োগ— মোহক, তোমাহক, আমাহক। (২) [ষষ্ঠী বিভক্তি [হিন্দির বিবিধ শাখার কথ্য ভাষায় বা বোলীতে কর, ক, র এবং আকারাদি স্বর-যোগে বিভিন্ন উচ্চারণ-জাত কা, কে, কো, কের, কার ইত্যাদির অনুকরণে। পূর্ব্বমাগধীতে সম্বন্ধে ক, কের, কেরক ও পরবর্ত্তী বিকারে বাংলা এর। “আপন কাজক লাগি।” “যমুনাক তীর।” —শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন। তুলনামূলক—ওড়িয়া ‘র,’ প্রাচীন বাংলার— ‘র’ এবং ‘ক’ উভয়েরই ব্যবহার আছে] “হাথক দরপণ মাথক ফুল, নয়নক অঞ্জন মুখক তাম্বুল।” —বিদ্যাপতি। “শ্রবণক পথ।” “দশনক চিন।” তুলনামূলক— ‘হাথর’, ‘সংসারক’। —শূন্য পুরাণ। (৩) হেতু অর্থে [বিহারী হিন্দি— লাগি, লাগে > বাংলা গ্রাম্য— নেগে। অসমিয়া— ‘ল’] ‘যুড়িবাক’ = যুড়িবার জন্য; ‘ত্যেজিবাক’ = ত্যাগের নিমিত্ত; ‘হাঁঠীবাক’ = চলিবার জন্য। ভাঁগিল সোনার ঘট যুড়িবাক পারী।” —শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন। ১০ সত্ত্বেও; তথাপি শব্দের আকাঙ্ক্ষা-বোধক ‘কেন’ অর্থে। “যেথা আমি যাই নাক, তুমি প্রকাশিত থাক।” —রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১১ ভ্রক্ষেপ না করা বা উপেক্ষার ভাব-বোধক ‘কেন’ এই অর্থে (তখন ‘না’-র সহিত যুক্ত হয়)। প্রয়োগ— বলুক নাক। এখন করুক নাক, পরে দেখে নেব। যাব নাক ইত্যাদি নাক = না-কেন। ১২ প্রশ্নে নিশ্চয়তা বা দৃঢ়তা অর্থে। “আচ্ছা তুমি যাবে না ক?” ১৩ (ক̑) সতর্কীকরণে যেন অর্থ-বোধক। “ছিন্ন মালার ভ্রষ্ট কুসুম ফিরে যাসনে ক কুড়াতে।” —রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

৩. ক̆

[কহ, কও শব্দের সংক্ষেপে (দ্রুত উচ্চারণ হেতু) অবজ্ঞায়—অনুজ্ঞা বাচক। প্রাচীন বাংলা উকারান্ত অনুজ্ঞাত্মক ক্রিয়াপদ— করু, হরু, হউ, দেহু, লেহু ইত্যাদির প্রাদেশিক মধ্য বাংলায় উর সহিত কা ও পরে ক যুক্ত হইত— করুকা, হরুকা ইত্যাদি— করুক, দিউক, হউক ইত্যাদি। এইরূপ ঊনবিংশ শতাব্দীর পণ্ডিতী বাংলায় ক্রিয়াপদে ক যুক্ত হইয়া করিবেক, হইবেক, করিলেক, খাউক, খাক, দিক, লউক (গ্রাম্য কথ্য— নিক, নিগ) ইত্যাদি। “বিবেচনা করিলেক।” “নিন্দা-করিবেক।” —তোতা ইতিহাস] ক্রিয়া, বল্; বর্ণনা কর্। প্রয়োগ— কথা ক। যা যা দেখে এলি ক দেখি। ক̆আ, ক̆হা—বলা; উল্লেখ করা; বর্ণনা করা। ক̑ই, ক̑হি—উত্তমপুরুষ, বলি। ক̆ও, ক̆হ̆, ক̆য়, ক̆হে—প্রথমপুরুষ বলে। অসমাপিকা-ক্রিয়া ক̑ইতে, ক̑হিতে— বলিতে; বলিবার জন্য। (২) কহিতে স্থলে (দ্রুত উচ্চারণ হেতু) ক̑ইতে পরে, কৈতে ব্রজবুলি— ক হইতে। কহা দ্রষ্টব্য।

সংসদ বাংলা অভিধান

১.

বাংলা বর্ণমালার প্রথম ব্যঞ্জনবর্ণ এবং অঘোষ অল্পপ্রাণ কণ্ঠ্য ক্-ধ্বনির দ্যোতক বর্ণ।

২.

ক্রিয়া (তুচ্ছার্থে) কহ, বল। [বাংলা √ কহ্]।

৩.

বিশেষণ. কয়, কত (ক-রকম, কখানি)। [বাংলা. কয়]।

৪.

, কো (কাব্যে বা কথ্য) নিষেধাত্মক শব্দকে শ্রুতিমধুর, মিনতিপূর্ণ বা জোরালো করবার জন্য স্বার্থে ব্যবহৃত প্রত্যয়বিশেষ (যেয়ো নাকো, নেইকো)।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ

শব্দসূত্র