1. বাংলা বর্ণমালার তৃতীয় বর্ণ; আলিকালির তৃতীয় স্বর; হ্রস্ব স্বর। উচ্চারণ স্থান তালু; উর্ধ্ব সম্মুখ তালব্য ‘ই’ ধ্বনির দ্যোতক। ব্যঞ্জনবর্ণের সাথে যুক্ত হলে ‘ি’ এইরূপ আকার হয়। যথা—ক্ + ই = কি।
  2. ইকার ব্যঞ্জনবর্ণের পূর্বে বসে বলে পূর্ব বঙ্গে ইকারের উচ্চারণ প্রথমেই করা হয়। যথা— করিয়া = কইরা; উড়িয়া = উইড়া। তুলনামূলক ‘উইড়া যাইতে পইখটা পুইড়া পুইড়া মরে।’ — সূর্য উঠাইবার ছড়া (বিক্রমপুরের ইতিহাস)।

সর্বনাম

  1. এ; এই; ইহা। ‘ইধন যার ঘরে নাই তার মিছাই জীবন।’—ছড়া। ‘দিগ্বিজয়ী বেশ ধর ইবেশ ছাড়িয়া;’ ‘ই ভব তরিতে সেতু;’ ‘ই বড় বিষম ঠাঁই;’ ‘ই হেতু পাঁচালী কবি করিল প্রকাশ।’—দুর্গামঙ্গল।
  2. ২৪পরগণা, হুগলী, নবদ্বীপ ইত্যাদি স্থানে ‘এই’ শব্দের ‘এ’ মাত্র এবং বর্ধমানাদি অঞ্চলে ‘ই’ মাত্র ব্যবহৃত হয়।

ব্যুৎপত্তি

  • সংস্কৃত ইদম্ = ইম্ (‘দ’ লোপে) = ই (প্রাকৃতে ‘ম্’ লোপে) ইদম্ শব্দের প্রাকৃত রূপ। সর্বনাম রূপে ব্যবহৃত হলে বাংলায় ‘ইহা, এই’ হয়। এস্থলে হিন্দিতে শুদ্ধ ‘ই’র ব্যবহার আছে। প্রাদেশিক উপভাষা, গ্রাম্য প্রাচীন বাংলায় হিন্দির অনুকরণে।

অব্যয়

  1. বাক্যে বক্তব্য বা বক্তব্যের কোন অংশ দৃঢ় করণার্থে বাংলায় ‘ই’ যুক্ত হয়। প্রয়োগ— গেলামই বা, যদিই বা হয়, না বল নাই বলিলে।
  2. খেদ; কোপ; নিন্দা; বিস্ময়; সম্বোধন; আহ্বান; নিরাকরণ।
  3. কেবলমাত্র; একমাত্র; অনন্যবাচক। প্রয়োগ— সেখানে আমিই ছিলাম; তাকেই যেতে হবে।
  4. নিশ্চয়সূচক। আমি বলবই। বাড়িতেই থাকবে। কাজটা করবই করব। প্রাচীন বাংলায় (চর্যাপদ ৩৯.২)।
  5. অগ্রাহ্য বা অবজ্ঞাসূচক। প্রয়োগ— যেই কেন আসুক না সে কারও কথা শুনবে না; কেনই বা সে শুনবে; কেই বা তার কথা শুনেছে। আহা, কী গানই গাইলে!
  6. হেতুবাচক। প্রয়োগ— তার কথাতেই ত আগুন জ্বলেছে, না হলে কি এত কাণ্ড বাধে? কাজেই বলতে হয় তারই যত দোষ।
  7. বিশেষবাচক। প্রয়োগ— কিছুইত কাজে এল না। এত বয়স হল ছেলেটা কোন কাজেরই হল না।
  8. আধিক্য বা পরিমাণ সূচক। প্রয়োগ— যতই বল আর যতই কর ভবি ভুলবার নয়। যতই বল, কতই বা আর খাবে।
  9. অবিরাম অর্থে – বৃষ্টি হচ্ছে তো হচ্ছেই।

বিশেষ্য

  1. [ই (গমনে) + (কর্তৃবাচ্য, ক্বিপ্)] কামদেব।

বিশেষণ

  1. পূরণবাচক বিশেষণে – সাতই চৈত্র। অনিশ্চয়ার্থে -দেখলই যদি, যদিই বা যায়।
  2. পাদ পূরণে ‘হি’ = ই।

ব্যুৎপত্তি

  1. সংস্কৃত ‘হি’, হিন্দি ‘হী’; তুলনামূলক সংস্কৃত এব।

ব্যাকরণ

  1. যুক্ত অর্থে; আছে এই অর্থে। যথা—ভারি; দাগি।
  2. স্বার্থে। যথা— হাসি।
  3. সম্বন্ধার্থে। যথা— সরকারি।
  4. ধর্ম অর্থে। যথা— লম্বাই; খাড়াই।
  5. ব্যবসায় অর্থে। যথা— ডাক্তারি; ক্ষেতি; গোলদারি।
  6. সাদৃশ্যার্থে। যথা— বড়মানুষি।
  7. তদুৎপন্ন; তদ্‌জাত; তন্নিমিত্ত। যথা— পাটনাই; কাবুলি। তদ্দেশীয় হলে ‘ঈ’ যথা— কাবুলী; বিহারী; বাঙ্গালী।
  8. ক্ষুদ্রার্থে। যথা— হাঁড়ি, কলসি; নুড়ি ঢাকনি, ঝুড়ি, খুন্তি ইত্যাদি। বৃহদর্থে আ দ্রষ্টব্য।
  9. দক্ষ অর্থে। যথা— হিসাবি।
  10. দিন নির্দেশ বা নির্ধারণার্থে। যথা— সাতই, আটই। লক্ষ্যণীয়, — ৫ই হতে ১৮ই পর্য্যন্ত ‘ই’ তারপর ‘এ’। যথা— উনিশে ‘এ’ দ্রষ্টব্য।

ব্যুৎপত্তি

  1. বাংলা প্রত্যয় বিশেষ।

প্রত্যয়

  1. কথার মাত্রা স্বরূপ কেবল উচ্চারণার্থে। যথা— ‘মনের আগুনি মনে নিভাইতে।’ —অনন্তদাস। ‘সাঁঝর বেরি।’ —বিদ্যাপতি। ‘সগরি রাতিয়াঁ।’ ‘কিরাতি’ (কিরাত স্থলে)। এইরূপ ‘শপথি’ (শপথ স্থলে)। ‘যেমতি করিয়া শপথি করিল।’ —চণ্ডীদাস।
  2. কর্তা স্ত্রী হলে ব্রজভাষায় ক্রিয়াপদে ইকার যুক্ত হয়। ‘ভেলি বরনারী।’ ‘গেলি কামিনী গজহ গামিনী।’—বিদ্যাপতি।
  3. সপ্তমী বিভক্তি বাচক। ‘গুরুজন সমুখই ভাব তরঙ্গ।’ —বিদ্যাপতি।
  4. অসমাপিকা-ক্রিয়া, বিভক্তি ই আ বা ইয়ার সংক্ষেপণ, পদ্যে প্রচলিত। প্রয়োগ— করি = করিয়া, দেখি = দেখিয়া। অতি প্রাচীন বাংলায় ও এর ব্যবহার ছিল। ‘বীঅলই।’ (বৌদ্ধগান ও দোহা) = বীজ লইয়া।
  5. [প্রাচীন বাংলা] বিশিষ্টার্থক ‘ইত’ (সংস্কৃত কর্মবাচ্য -বিভক্তি) প্রত্যয়ের সংক্ষেপণ। ‘বিকসই’ = বিকসিত (‘জিণরঅণ বিকসই সা।’ —বৌদ্ধগান ও দোহা)। ইত = ইঅ = অই।
  6. নামধাতু গঠনে সংস্কৃত ‘তি’ ও ‘তে’ প্রাকৃত নিয়মে ‘ই’ বিভক্তি। যথা—অমৃত > অমৃতায়তে, অলীক > অলীকায়তে, চিহ্ন > চিহ্নয়তি, পল্লব > পল্লবয়তি ইত্যাদি। প্রাচীন বাংলায় এর ভূরি প্রচলন ছিল। শাস্ত্রী মহাশয় সম্পাদিত ‘হাজার বছরের পুরাণ বাংলা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা’ গ্রন্থ হতে কতকগুলি আধুনিক বাংলায় ব্যবহৃত নামধাতুর তৎকাল-প্রচলিতরূপ প্রদত্ত হল। যথা—করিঅই, করিজ্জই, কীঅই— করা যায়। কহই, কহেই—কহে। কহিজ্জই, কহিটঅই—কহা যায়। খজ্জই—খায়। খাই—খায়। খেলই—খেলে। গজিই—গজায়; গজিয়ে উঠে। গটই—গড়ে। গমই—গমন করে। গাহই—গ্রহণ করে। ঘুমই—ঘুমায়। চিন্তই, চিন্তজ্জই—চিন্তা করে; চিন্তা করা যায়। চ্ছড়ই—ছাড়ে। চ্ছিজ্জই—ছেঁড়ে। ছুপই—ছোঁয়। জাঅই—যায়। জাণই—জানে। জীবই—বাঁচে। ঠাই—থাকে। তুটই, তুট্টই—টুটে। ত্থিপ্যই—লেপন করে। থক্কই—থাকে। দেই—দেয়। দেখই—দেখে। ধরই, ধরিজ্জই—ধরে; ধরা যায়। ধাবই—ধাবন করে। নিরজ্জই—নিবৃত্ত হয়। পইঠ্‌ঠই, পইসই, পইসঈ—পশে; প্রবেশ করে। পতিআঈ—প্রত্যয় করে। পতেই—পতিত হয়। পাবি অই, পাবিজ্জই—পায়; পাওয়া যায়। পিবই—পান করে। পুচ্ছই—প্রশ্ন করে। বক্‌খাণই, বক্‌খানিজ্জই—ব্যাখ্যান করে; ব্যাখ্যা করা যায়। বট্টই—বর্তন করে। বসই—বসে; বাস করে। বহই—বহন করে। বাহই—বাহন করে। বিণাসই—বিনাশ করে। বোলই—বলে। ভাবই—ভাবে। মণঅই—মনে হয়। মরই—মরে। মরিআই—মরে যায় (তুলনামূলক হিন্দি মর্ মরায় গয়ে)। মাণই—মাণে। মারই—মারে। মিলন্তেই—মেলে। রজ্জই—রাজে; বিরাজে; শোভে।
  7. প্রবৃত্ত হয়। লক্‌খই—লক্ষ্য করে। লব্বই, লাভই লাভ করে; লভে। ষজ্জই—সাজে। সকই—শক্য হয়; পারে। সিজ্ঝই—সিঝে; সিদ্ধ করে।

ব্যুৎপত্তি

  1. ব্রজবুলি ও প্রাচীন বৈষ্ণব সাহিত্য।
পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ

শব্দসূত্র