১.

/ আ / ɑ / ā / aa /

বাংলা লিপি, আলিকালি ও বাংলা স্বরবর্ণমালার দ্বিতীয় বর্ণ; মৌলিক স্বরধ্বনি আ (ɑ)-এর প্রতীক। দীর্ঘ ও প্লুত স্বর; একমাত্রাবিশিষ্ট বা হ্রস্ব ‘অ’-কারের দ্বিমাত্র বা দীর্ঘ উচ্চারণে আ-কার হয়। উচ্চারণ স্থান কণ্ঠ; কণ্ঠ্যবর্ণ। জিহ্বা মুখবিবরের নিম্নদিকে সঙ্কুচিত করে ও মুখ ব্যাদান করে উচ্চার্য। বাংলায় সাধারণত ‘আ’-কারের লঘু, গুরু, ভেদে ৩ প্রকার উচ্চারণ,—(১) লঘু বা অল্প পৃষ্ঠ—আঠা বা আম্‌সির আ, (২) আটা বা আমের ‘আ’, (৩) সঙ্গীতে আ-া-আ— (বাঙ্গালা ভাষার অভিধান)। আধুনিক বাংলায় ‘আ’-কারের উচ্চারণ হ্রস্বমাত্রক; গান ও বিবৃত আহ্বান প্রভৃতিতে দুই বা ততোধিক মাত্রায় উচ্চারিত হয়। ‘আগর, আনচান, আমল, কালো, দাতা’ প্রভৃতির আ-কার একমাত্রক বা হ্রস্ব। গানে ‘তারা … দিলে না দিলে না দিন’ (দাশরথি) এবং ‘ওরে গদা …’ ইত্যাদিতে আ-কার প্লুতমাত্রক (বঙ্গীয় শব্দকোষ)। ‘মা, আপন’ প্রভৃতি শব্দে ‘আ’ দীর্ঘ। অন্য বর্ণের সাথে যুক্ত হলে ‘া’ (আকার) রূপ ধারণ করে। যথা—ক্ + আ = কা। সেমিতীয় বর্ণমালার প্রথম বর্ণের সাথে তুলনীয়, আলেফ়্ বা আলিফ়্ (ا); গ্রীক আল্‌ফ়া (α); মিশরীয় আহ্‌ম্; সংস্কৃতোদ্ভব যাবতীয় ভাষায় ‘আ’। প্রাচীন বাংলায় উচ্চারণ সাম্যে আকার স্থানে ‘য়া’ দেখা যায়; ‘য়াইলাম (আইলাম), য়াসিয়া (আসিয়া), য়াইসে (আইসে), য়াইলুম (আইলুম), য়াইল (আইল) ইত্যাদি (গোরক্ষবিজয় দ্রষ্টব্য)। এছাড়াও প্রাচীন বাংলায় ‘অ’ এবং পদান্ত ‘য়া’ ও আদ্য ‘রা’ স্থলে ‘আ’-র ব্যবহার ছিল। যেমন— অধর = আধর; অকারণ = আকারণ। চিন্তিআ = চিন্তিয়া (আধুনিক বাংলা)। রাস্তা = আস্তা। রান্ধে বাড়ে = আন্ধে বাড়ে (ময়নামতির গান)।

২.

/ আ / ɑ / ā / aa / [ব্যাকরণ] বাংলা প্রত্যয় বিশেষ,—

  1. স্বার্থে— মাথা; গোয়ালা; ল্যাজা।
  2. সাদৃশ্যার্থে— হাতা (জামার), জলুআ, পেঁচলা (পিচ্ছিল)।
  3. অনাদরে, অবজ্ঞায় বা অতিপরিচয়ে— পাগ্‌লা, শামা, মটকা, বাদলা, গোবরা। প্রাচীন বাংলায় ‘কাহ্নাআ’ (শ্রীকৃষ্ণকীর্তন)। তুলনামূলক হিন্দি কাহ্নাইআ।
  4. যুক্তার্থে— তেলা; লোনা; বেসুরা।
  5. বৃহৎ অর্থে— হাঁড়া; ঝোড়া; খোন্তা; ঢাকনা।
  6. বিশেষণে— আধা পথ; কাটা মুণ্ড।
  7. সর্বনামে— আমা, তোমা, যা, তা ইত্যাদি।
  8. সম্বন্ধার্থে— ঘরোয়া কথা।
  9. জাত অর্থে— পানা; ভয়সা ঘী (মহিষা = হিন্দি ভৈঁসা = বাংলা ভয়সা)।

৪.

/ আ / ɑ / ā / aa /  অব্যয়,—

  1. সুখবোধ; আনন্দ। ‘আ! কি আরাম!’ ‘আ, বেড়ে লাগছে!’
  2. স্মরণ। ‘আ তাই বটে!’
  3. বিস্ময়; সস্নেহবিস্ময়। ‘আ মরিয়া যাই? সোনা আমার, তোর কাকীমাকে এখনো ভুলিস্ নাই।’—রবীনাথ ঠাকুর।
  4. অনুকম্পা। ‘আ দেবদত্তো দরিদ্রঃ (শ.ক)
  5. সন্তাপ। ‘আ কি বিপদ।’—মালতীমাধব।
  6. সহানুভূতি। ‘আ মরে যাই।’ ‘আ, বড় ক্ষিদে পেয়েছে!—খাও, খাও!’ ‘আ, মরে যাই! বড় লেগেছ!’
  7. নিশ্চয়।
  8. ব্যঙ্গ। ‘আমরি আমরি যমেরি ভুল।’—নবীন তপস্বিনী।
  9. ঘৃণা, লজ্জা, ক্রোধ মিশ্রিত বিদ্রূপ। ‘আ মরণ আর কি?’ ‘আ গেল যা।’ ‘আ মরণ? পোড়াকপালী বলে কি।’—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘আ মর! টগ্‌রে ছোঁড়া বলে বেড়ায় দাদা কুসঙ্গ ছাড়লে বড় সুখের বিষয় হবে!’— আলালের ঘরের দুলাল। ‘আ বেটা কি সাওখোড়!’ ‘আ মর মিন্‌ষে!’ ‘আস্পর্দা কম নয়!’
  10. ধিক্কার; আত্মগ্লানি; খেদ; বিষাদ। ‘আ পাপীয়সি দুর্বিনীতে মহাশ্বেতে! ইনি তোমার কি অপকার করিয়াছিলেন?’ ‘আ এখনও জীবিত আছি।’ —কাদম্বরী। ‘এই হতভাগিনীর মৃত্যু নাই!’ —ঐ
  11. প্রশংসা; বাহবা। ‘কি শোভা আ মরি হায়।’—কবি রঘুনাথ দাস।
  12. বিরক্তি। ‘কুটিলে বলে আ মর মাগি! মিথ্যে বলব কিসের লাগি?’—দাশরথিরায়ের পাঁচালী। ‘আ মুয়ে আগুণ! তামাক দুছিলিম এনে রাখব, তা ভুলে গেছি!’—গিরিশ গ্রন্থাবলী। ‘আ মলো! মাগী বাড়ী ব’য়ে কোঁদল কর্‌তে এসেছে দেখি যে! —বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
  13. সপ্রণয় গালি। ‘আ মলো! কে কালামুখি! “জয় সুলোচনা জয়”— তোর বুঝি কণ্ঠে নাহি সরে? ন। ‘আ মলো! মেয়েমানুষে পুরুষমানুষে সমান!’—বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
  14. ক্লেশের বা দুঃখের শান্তি। ‘আ! বাঁচলাম!’
  15. নৈরাশ্য। ‘আ! এইবার মলাম! আর রক্ষা নাই!

৫.

/ আ / ɑ / ā / aa / বাংলা উপসর্গ বিশেষ।

  1. অসম্পূর্ণ; অর্ধ; ঈষৎ; অল্প ইত্যাদি অর্থে— আনত; আকুঞ্চিত; আকম্পিত; আপিঙ্গল; আলোহিত; আপোড়া; আভাজা, আকালা।
  2. সম্যকার্থে—আগত; আজীবন; আজানু; আবালবৃদ্ধবনিতা; আব্রহ্মপর্য্যন্ত (চৈতন্যভাগবত); আজন্মকালাবধি (আলালের ঘরের দুলাল); আপাদপর্য্যন্ত (ধর্ম্মমঙ্গল) ইত্যাদি।
  3. সীমা; অবধি; পর্যন্ত; মর্যাদা; হতে অর্থে— ‘আজন্ম; আকণ্ঠ, আকর্ণ, আব্রহ্ম, আশৈশব, আমরণ, আপাদমস্তক, আসমুদ্রহিমাচল।—আসিন্ধুনদীতীর আর হিমালয় (চৈতন্যচরিত); নিত্য আকল্প তুমি সেই ভগবান (শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল)।
  4. নঞর্থক—আলুনি, আছোলা; আচাঁছা; আঘাটা; আধোয়া।
  5. বিপরীতার্থক—আগমন (গমনের বিপরীত)।
  6. বিপর্যয়, অগ্রহণ, প্রত্যাবর্তন অর্থে—আগমন; আদান; আমুক্ত; আয়াত।
  7. সমন্তাৎ, সম্পূর্ণ, সর্বত্র বা সর্বতোভাবে অর্থে— আকাশ [আ (সর্বতোভাবে) কাশ (প্রকাশ পায়)—যে বা যা সর্বতোভাবে প্রকাশ পায়]; আকীর্ণ; আক্ষেপ।
  8. সাদৃশ্যার্থে—আকাট (যেন কাট)।
  9. ক্রিয়াযোগ—আলোকেতে; আশঙ্কতে ইত্যাদি।

৬.

/ আ / ɑ / ā / aa / বাংলা বিভক্তি বিশেষ—

  1. ক্রিয়াবিভক্তি— প্রাচীন বাংলায় সম্ভ্রমার্থে বহুবচনে আকারান্ত হ’ত। ‘ঠাকুরাণী গিএ তথা দিলা দরশন।’ —শূণ্যপুরাণ। করুক + আ (সম্ভ্রমার্থে) = করুকা। এইরূপ হরুক + আ = হরুকা। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে এই ‘আ’ স্থলে আন্ পরে ‘ন’ হয়। যথা—করুকান > করুন।
  2. অসমাপিকা ক্রিয়া বিভক্তি ‘য়া’ স্থলে প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে ‘আ’র ব্যবহার ছিল, যথা—চিন্তিআ (চিন্তিয়া = চিন্তা করিয়া, হাসিআ (হাসিয়া = হাস্য করিয়া) ইত্যাদি (চৈতন্য মঙ্গল),
  3. প্রাচীন বাংলায় ‘য়া’ স্থলে প্রাকৃতের অনুরূপ বিশেষ্য পদেও ‘আ’র ব্যবহার ছিল, যথা, সংস্কৃত হৃদয় > প্রাকৃত হিঅঅ > প্রাচীন বাংলা হিআ (হিয়া); সংস্কৃত বদন > প্রাকৃত বঅন > প্রাচীন বাংলা বআন (বয়ান); সংস্কৃত সাগর > সাঅর > সায়ার ইত্যাদি।
  4. আধুনিক বাংলায় বিশেষ্য বিভক্তি। প্রয়োগ—দোলনা; খেলনা; দেনা-পাওনা; বাটনা ইত্যাদি।
  5. মৈথিলী বাংলা—প্রাচীন বৈষ্ণব সাহিত্যে আকার কথার মাত্রা। যথা— ‘নয়ন’ স্থলে ‘নয়না’, ‘কহল’ স্থলে ‘কহলা’ (বিদ্যাপতি পদাবলী); বঁধুয়া (চণ্ডীদাস); রসালা (গোবিন্দ দাস) ইত্যাদি।
  6. প্রাচীন বাংলা বহুবচনবোধক নাম শব্দে ‘আ’ যোগ হইত। ‘নরা গজা বিশ শয়, * * বাইশ বলদা, তের ছাগলা।’—খনা। এইরূপ—কাগা, বগা ইত্যাদি।
  7. সংস্কৃত ও আধুনিক বাংলায় অ স্থলে প্রাচীন বাংলায় আ। ‘আবুধি (অবুদ্ধি), আবেলা (অবেলা), আনলে (অনলে) আনুপম ইত্যাদি (শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বৈষ্ণব সাহিত্য)।
  8. প্রাচীন বাংলায় হস্তলিপিতে আ ও’র সহিত যুক্ত হয়ে ‘ওয়া’র স্থান অধিকার করত। ‘বলা নয় ব্রজে যাওয়া বিষম সঙ্কট।’—শীতলামঙ্গল (নিত্যানন্দ)।
  9. [সংস্কৃত আগমনার্থক আ ধাতু। উর্দু, হিন্দি আনা; অসমিয়া আ ধাতু (ওড়িয়া আ) তুলনামূলক হিন্দি আ= তেলুগু ৱা = বাংলা আ, আয়। উত্তম পুরুষ—আই (আসি), মধ্যম পুরুষ—আও, প্রথম পুরুষ—আএ, আওয়ে (হিন্দি—আৱে), অসমাপিক-ক্রিয়া,—আইতে। এইরূপ আইব, আইবে, আইত, আইলাম ইত্যাদি আধুনিক বাংলায় ই স্থলে সি] ক্রিয়া, আসা; আগমন করা।
  10. বাংলায় ক্রিয়াপদ নিষ্পাদনে। যথা— বলা, করা, দেখা, যাওয়া, শোয়া ইত্যাদি তুলনামূলক হিন্দি ‘না’ যথা,—খানা, দেখ্‌না, বোলনা, লেনা, দেনা ইত্যাদি।
  11. আ = এ (দ্রষ্টব্য)। ‘খাতি = খেতে, আজ্ঞা = এজ্ঞে।’
  12. অ = (প্রাচীন বাংলায়) আ, আধিক (অধিক), আধিকার (অধিকার), আধিকারী (অধিকারী), আধিন (অধীন) ইত্যাদি।
  13. ইয়া এবং এ (১২) দ্রষ্টব্য।

৭.

/ আ / ɑ / ā / aa / বিশেষ্য,

শিব; বিষ্ণু; অনন্ত।
পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ

শব্দসূত্র