১.

বাংলা স্বরবর্ণমালার একাদশ বর্ণ। উচ্চারণ-স্থান কণ্ঠ ও তালু। মুগ্ধবোধমতে শুদ্ধ তালু। ‘এ’ দীর্ঘস্বর ব্যঞ্জনবর্ণের সাথে যুক্ত হলে ‘ে’ এইরূপ আকার হয়। যথা—ক + এ = কে। এটি অ + ই এই দুই স্বরযোগে উচ্চারিত হয় বলে এটিকে সন্ধ্যাক্ষর বলে। বাংলায় এর হ্রস্ব, দীর্ঘ ও প্লুত স্বর আছে। যথা— এক (হ্রস্ব] (২) একুশ [দীর্ঘ] (৩) মেঘ; এরে (শিশুকে ধমক দিবার কালে) [প্লুত]; প্রাচীন বাংলা পদান্তে একারের হ্রস্বস্বর আধুনিক চলিত, বাংলায় দীর্ঘস্বরে ও সাধু ভাষায় [হিন্দির অনুকরণে] ‘ইয়া’তে পরিণত। যথা— কর্ যা = করে = করিয়া। “অগ্নি লেগে ললাটে লিখন গেল জ্বল্যা।” —শিবায়ণ। এখানে জ্বল্যা—জ্ব’লে = জ্বলিয়া [যা হ্রস্ব এ বা ্যা যোগে পূর্ববঙ্গ ইত্যাদি স্থানে উচ্চারিত, ২৪পরগনা, হুগলি ইত্যাদি অঞ্চলে তাই দীর্ঘস্বর সংযোগে উচ্চারিত হয়] প্রাচীন বাংলায় ‘এ’ অধুনা ‘য়‘যড়’তে পরিণত। যথা— হএ = হয়। “নৃপতি হুসেন সাহ হএ মহামতি।” মহাভারত (কবীন্দ্র পরমেশ্বর)। [ই (গমন করা) >] বিশেষ্য, বিষ্ণু। ২ স্মৃতি; স্মরণ। ৩ [= হে] সম্মোধন; আহ্বান; ডাকা। ৪ সহানুভূতি; অনুকম্পা; দয়া। ৫ অসূয়া। ৬ ঘৃণা। ৭ পৃথিবী [অপ্রচলিত] ৮ [বৌদ্ধ বাংলা প্রাকৃত দোহী ৮৩, ৮৪, চর্যাপদ ৬/৪ ইত্যাদ] এই। “এ বণ চ্ছাড়ী হোহু ভান্তো।” —চর্যাপদ ৬/৪। “এ বিশ্বাস এড়াইবার এখন আর উপায় নাই।” — সনাতনী। ৯ [ইহা > এহা > এ] ইহা। “এ বড় বিষম কথা।” —সনাতনী। ১০ উপস্থিত; বর্তমান। ১১ এমন; এপ্রকার। ১২ আগামী; সামনে; সম্মুখবর্তী; পুরোবর্তী। ১৩ মধ্যে; মাঝে। “এ সখী, সুন্দরী যুবতী জনে, হরি নাচত কত প্রকার।” —গীতগোবিন্দ (গিরি)। এ-রবিবার নয় ও- রবিবারে যাব। ১৪ অনির্দিষ্ট সমূহ, অনেক, সকল বা সাধারণ অর্থে। “পাগলে কি না বলে ছাগলে কি না খায়।” “লোকে বলে” ইত্যাদি। এ ১১ দ্রষ্টব্য।

২.

[ব্যাকরণ ‘ইয়া’র সংক্ষিপ্তরূপ] বাংলা প্রত্যয়-বিশেষ। দেশবাচক—তদ্দেশে প্রচলিত; তদুৎপন্ন। প্রয়োগ— শান্তিপুরে লৌকতা; ঘাঁটালে হাঁড়ি; চীনে বাসন। (২) অস্ত্যর্থে। প্রয়োগ— ঠেকারে; লাল-পেড়ে কাপড়। (৩) ব্যবসায়ী অর্থে। প্রয়োগ— জেলে, নেয়ে (নাবিক)। (৪) প্রকার বা ভাবার্থে। প্রয়োগ— ঢিলে; কিরকিরে; মিটমিটে। (৫) কর্তা এই অর্থে। প্রয়োগ— খোসামুদে; ফলারে। (৬) তন্নির্মিত অর্থে। প্রয়োগ— মেটে বাড়ী। (৭) দিন, কাল, বয়স, নির্দেশার্থে ১৯ হতে ঊর্ধ্বসংখ্যার (সাধারণতঃ সত্তরের কোটা পর্যন্ত) পূরণবাচক] প্রয়োগ— বিশে, ত্রিশে, বাহাত্তরে। (৮) হিন্দী ‘হি’র রূপান্তর। তুলনামূলক— বারহি = বারে] নিশ্চয়ার্থে। “বারে বারে তুমি ভেবো না কমলিনী।” —বাংলা গীত। ২ বাংলা বিভক্তি। প্রাকৃত ‘এ’র অনুকরণে। কর্তৃকারকে, প্রথমা বিভক্তি। প্রয়োগলোকে বলে। প্রাচীন বাংলয় “কংশে পুতনাক নিয়োজিল।” —শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। “শুনিয়া রাজা এ বোলে হইয়া কৌতুক।” —মহাভারত (সঞ্জয়)। “কোন মতে বিধাতাএ করিছে নির্ম্মাণ “রামেশ্বরী মহাভারত (বঙ্গভাষা ও সাহিত্য)। (২) [এ = কে] কর্ম-কারকে, দ্বিতীয়া বিভক্তি (প্রথমা অনুকরণে)। “দেখি রাধার রূপ যৌবনে,” “বনমাঝেঁ পাইল তরাসে।” ‘তাএ (-তাহাকে) —শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। “তোমার পিতাজনকে দিব অর্দ্ধেক দেশ।” —কৃত্তিবাস (৭৫ বৎসরের পুঁথি) সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা ১৩০১। “লাজ কেন কর বধূজনে,” —কবিকঙ্কন। “জগন্নাথে প্রণমিল অষ্টাঙ্গ লোটিয়া।” (৩) [পদান্ত এ, এঁ = পালি হিন্দি < সংস্কৃত — ভিঃ = বাংলা প্রাকৃত = ই = এ তে = ত (ছুরিত = ছুরিতে = ছুরিএ প্রাচীন বাংলা) আধুনিক বাংলায় (লতাভিঃ > লতাহি > লতাই = লতাএ = লতায়। “তোমায় আমার আজ বোঝা পড়া হবে।” (তুলনামূলক— “অদ্য যুদ্ধং ত্বয়া ময়া”)] করণকারকে, তৃতীয়া বিভক্তি (দ্বারা, দিয়া অর্থে instrumental case, denoting suffix, by. “পর পুরুষের নেহা এঁ যাহার বিষ্ণুপুরে স্থিতী,” “মিছাই মাথাএ পাড়এ সান।” —শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। নিজের চোখে দেখা। তরোয়ালে কাটা। হাতে মাথা কাটা। ঘিয়ে বা তেলে ভাজা। (৪) সম্প্রদান কারকে। [প্রাচীন বাংলা ‘মো এ’, ‘আহ্মাএ’ = আধুনিক বাংলা ‘আমাকে’, ‘আমাদিগকে’ ও চতুর্থী বিভক্তি। প্রয়োগ— দীনে কর দান। “ভিক্ষা দেহ রঘুবধূ ক্ষুদার্ত্ত অতিথে।” —মেঘনাদবধ কাব্য। নিমিত্তার্থে। “লোক হিতে দান।” (৫) প্রাচীন বাংলায় অপাদান কারকের বিভক্তি। হতে এই অর্থে। “চম্পাই নগরে (= নগর হতে) আসে চাঁদ সদাগর।” —কবিকঙ্কন। (৬) সম্বন্ধে ষষ্ঠী বিভক্তি ‘এর’ স্থলে প্রাচীন বাংলা ‘এ’। “বন্ধন দেখিয়া বীরে (বীরের) লজ্জা হৈল চণ্ডীর তখন।” —কবিকঙ্কন। অধিকরণে সপ্তমী বিভক্তি স্থলে (প্রাচীন বাংলা) ‘এ’ = (আধুনিক বাংলা) ‘য়’। যথা— (প্রাচীন বাংলা) বেলাএ = (আধুনিক বাংলা) বেলায়। “হেন বেলাএ দ্বারকাএ পড়িল প্রমাদ।” —চৈতন্য মঙ্গল। “দেশে দেশে মোর ঘর আছে।” —রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। “ঘরে থাকা ইত্যাদি থাকে।” (৭) বাংলা ক্রিয়া বিভক্তি। যথা— কৃ ধাতু হতে করে। ধৃ ধাতু হতে ধরে। “বহুকাল শাসে রাজা সব নৃপবরে।” —কৃত্তিবাসী রামায়ণ। (৯০ বৎসরের পুঁথি— সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা ১৩০১)। অসমাপিকা-ক্রিয়া-বিভক্তি। প্রয়োগ— ক’রে—করিয়া। দেখে গেল, যেতে দেবে না, ‘বলে যাও। (৮) ক্রিয়া-বিশেষণ, জোরে; মনে প্রাণে— এই অর্থে। প্রয়োগ— এক টানে তুলে ফেল। প্রয়োগ— এক চুমুকে দুধটা খেয়ে ফেল্লে। (৯) প্রাচীন বাংলা ক্রিয়ায় প্রথম পুরুষের বিভক্তি। কর + এ = করএ। এইরূপ পঢ়এ (আধুনিক বাংলা ‘করে’ ‘পড়ে’); ‘তাএ’ (= তাপিত করে, তাপ দেয়) —শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন। (১০) [হিন্দি— সকর্মক ক্রিয়ার কর্তায় যুক্ত ‘নে’ বৎ — “মৈঁনে দেখা।” প্রাচীন বাংলা নে = এ] নির্দিষ্ট অর্থে (এ ১৩ দ্রষ্টব্য)। “পণ্ডিতে বলিলে মানি,” “মায়ে বাপে বলিলে দোষ হয় না,” “বেরালে মুখ দিলে” ইত্যাদি। (১১) ‘আ’ স্থলে আধুনিক বাংলা ‘এ’। প্রাচীন বাংলা আলি (আইলি, আসিলি) = এলি; খাতি (খাইতে) = খেতে; আনিয়া > এন্যা > এনে; আজ্ঞা > আজ্ঞি > আইজ্ঞা > এজ্ঞে; এগ্‌ঁগে > এগ্গে [O. D. B. L.] আ দ্রষ্টব্য। ৩ [সংস্কৃত এষঃ > প্রাকৃ◦-এস > এহ >এহ্, হিন্দি— য়হ্ > এ] সর্বনাম, (অসম্ভ্রমার্থে) এই ব্যাক্তি। (২) এই বস্তু, জন্তু, বিষয়। এই, এটা—ইহা একে = ইহাকে। এতে = ইহাতে, এর = ইহার, এই ব্যাক্তির ইত্যাদি। সম্ভ্রমে = এঁ, এঁর, এঁকে, এঁতে— ইঁহার মধ্যে। বহুবচন— এদের, এঁদের, এদেরকে এঁদেরকে (উপভাষা)। প্রাদেশিক গ্রাম্য সম্ভ্রমে— এনা, এনার এনাকে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ

শব্দসূত্র